প্রকাশের সময় 23/03/2024
নেত্রকোনার দুর্গাপুরে তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও কৃষকের তেভাগা বা টঙ্ক আন্দোলন তথা হাজং বিদ্রোহের সংগ্রামী নারী নেত্রী কমরেড কুমুদিনী হাজং (৯২) আর নেই। শনিবার দুপুরে বার্ধক্য জনিত কারনে নিজ বাড়ী বহেড়াতলীতে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তিনি ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে সহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুর সংবাদ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে।
দুর্গাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেড়াতলী গ্রামে পাহাড়ী অঞ্চলের এক টিলায় বসবাস করতেন তিনি। হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী কুমুদিনী হাজং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধু, টংক আন্দোলন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি জুলুম বৈষম্য, নিপীড়ন, ১৯৬৪ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন কালের স্বাক্ষী। কুমিদিনী হাজং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনে পরাজিত হন নাই। পরাজিত হয়েছেন বার্ধক্যের কাছে। পরাজিত হয়েছেন নিজের জমি উদ্ধারের সংগ্রামে।
তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশ কৃষকদের টংক আন্দোলন দমাতে আন্দোলনকারীদের বাড়ী ঘরে হানা দেয়। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী হাজংদের কৃষক নেতা কুমুদিনী‘র স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে ঘরে না পেয়ে ব্রিটিশ পুলিশ নববধু কুমুদিনীকে জোর করে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে যাচ্ছিল দুর্গাপুর পুলিশ ফাঁড়ির দিকে। এই খবর পেয়ে বহেরাতলী গ্রামের রাশিমনি হাজং শতাধিক নারী পুরুষ নিয়ে দেশীয় দা, ঢাল, বল্লম, লাঠি, তীর ধনুকসহ সুমেশ্বরী নদীর তীরে কুমুদিনীকে ছেড়ে দিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু পুলিশ কোন কথাই না শুনে টেনে হিঁছড়ে কুমুদিনীকে দুর্গাপুরের পুলিশ ফাঁড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে রাশমনি হাজং দা দিয়ে পুলিশদের এলোপাতারি কুপাতে থাকলে একজন পুলিশ ঘটনাস্থলেই মারা যান। পুশিলের পাল্টা গুলিতে রাশিমনি হাজং নিহত হন। এ সময় সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজং সেই পুলিশকে কুপিয়ে মেরে ফেলেন। এ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ২২ জন হাজং কৃষক নারী-পুরুষ মারা যায়। পরে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পুলিশ কুমুদিনী হাজংকে ফেলে রেখে চলে যায়। গ্রামবাসীদের ওপর আরো হামলা হতে পারে এই ভয়ে লাশগুলো সুমেশ্বরী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পরদিন ব্রিটিশ পুলিশ বহেরাতলী গ্রামে তান্ডব চালায় এবং পুরো গ্রামকে তছনছ করে ফেলে। এ ঘটনার পর থেকেই রাশিমনি হাজং ও কুমুদিনী হাজংয়ের সাহসী লড়াই সংগ্রামের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কুমুদিনী হাজং এর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ২০০০ সালে মারা যান। তিনি দুর্গাপুরবাসীর কাছে গর্ব ও গৌরবের সংগ্রামী মুখ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তিনি বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তার মধ্যে, ১৯৯৯ সালে তেভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে পুরস্কার, ২০০৩ সালে অনন্যা শীর্ষ দশ নির্বাচিত পুরস্কার, ২০০৫ সালে স্বদেশ চিন্তা সংঘ ড. আহম্মদ শরীফ স্বারক পুরস্কার, ২০০৭ সালে মনি সিংহ স্মৃতিপদক পুরস্কার, ২০১০ সালে সিধু কানহু ফুলমনি পদক, ২০১৪ সালে জলশিঁড়ি পদক, ২০১৮ সালে হাজং জাতীয় পুরস্কার, ২০২১ সালে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক সম্মাননা, ২০২২ সালে পথ পাঠাগার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
তার মৃত্যুতে, স্থানীয় সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রেমন্ড আরেং, দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এম রকিবুল হাসান, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা কমরেড ডাঃ দিবালোক সিংহ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর পরিচালক গীতি কবি সুজন হাজং, দুর্গাপুর প্রেসক্লাব পরিবার, পথ পাঠাগার পরিবার, বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠন, সিপিবি নেত্রকোনা জেলা ও দুর্গাপুর উপজেলা কমিটি সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদন জানিয়েছেন। রোববার (২৪ মার্চ) সকালে স্থানীয় শ^শ্মানঘাটে তার অন্ত্যোষ্টিক্রীয়া সম্পন্ন হবে।